ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস): করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতি যখন মহাসঙ্কটে তখন বাংলাদেশ বড় ধরনের কোন সঙ্কট ছাড়াই কোভিডকালীন বছরটি অতিক্রম করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত ও সময়োপযোগি পদক্ষেপের কারণে মোকাবেলা করা গেছে অর্থনীতির সংকট। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন ও রপ্তানি বাণিজ্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বছরশেষে অর্থনীতির সূচকগুলো দেখাচ্ছে আশার আলো।
সরকারের নীতি-নির্ধারক, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের মতে সরকার কোভিড মোকাবেলায় যেসব সাহসী সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে,তাতে সামগ্রিক অর্থনীতি ধাক্কা কাটিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করেছে প্রণোদনা ও রাজস্ব সহায়তা।
কোভিডকালীন ২০২০ সালের অর্থনীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাসসকে বলেন, কোভিড মহামারি পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের অর্থনীতির তুলনা করলে দেখা যাবে, আমরা পাশ্ববর্তী দেশেগুলোর তুলনায় ভাল করেছি। বিশ^ব্যাংক,আইএমএফ ও এডিবির মত উন্নয়ন সহযোগি সংস্থাসমূহ বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছর শেষে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কম হবে না। তিনি বলেন,‘যদি সেটা হয়, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য বড় অর্জন।’
কোভিডের অর্থনৈতিক অভিঘাতের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, কোভিডের ক্ষতির পরিমাণ আর্থিকভাবে নিরূপন করা সহজ কাজ নয়। করোনাভাইরাসের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা করোনাভাইরাসের বিস্তার বড় আকারে রোধ করতে পারব বলে আশাবাদী। তখন পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য বড় প্রকল্প পুরোদমে বাস্তবায়ন করা যাবে।
করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সাল বাংলাদেশের জন্য কেমন ছিল, এ বিষয়ে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, কোভিড রোগি যখন দেশে প্রথম সনাক্ত হয়, তখন আমাদের তেমন প্রস্তুতি ছিল না। বস্তুত সারাবিশে^ কোথাও প্রস্তুতি ছিল না। তবে পরবর্তীতে আমরা ভাল প্রস্তুতি নিয়ে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ ও মৃত্যুহার কম রাখতে পেরেছি।
তিনি বলেন, কোভিড মোকাবেলা বা কৃষি ও শিল্পসহ সামগ্রিক অর্থনীতি বাঁচাতে সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মোট ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ত্রাণ সহযোগিতা প্রদান করতে এবং জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছে কার্যকরী পদক্ষেপ। বিভিন্ন পেশার প্রায় ২ দশমিক ৫ কোটি প্রান্তিক মানুষকে নগদ অর্থসহ দেয়া হয়েছে নানা সহায়তা। এতে কোভিড শুরুর দিকে ধাক্কা খাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কোন সঙ্কট তৈরি হয়নি।
জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদের মতে, কোভিডকালীন সময়ে সবচেয়ে ভাল করছে কৃষিখাত। বিশেষ করে বোরো তোলার সময় সরকার কৃষিতে যে সহযোগিতা করেছে, সেটি ফসল ঘরে উঠানো ও কোভিড মোকাবেলায় ভাল ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, আশাপাশের দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক কিন্তু আমাদের ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে সাড়ে ৪ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি।
তিনি মনে করেন বড় ও মাঝারি শিল্প খাতের প্রনোদনা বাস্তবায়ন হলেও ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ঘোষিত প্রণোদনা এখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি। তিনি এই ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দিকে আরও বেশি সহায়তা প্রদান ও কৃষিতে সহায়তা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের অভিমত, ২০২০ সালে কোভিড মহামারি মোকাবেলায় বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভাল করেছে,এর বড় কারণ করোনা ভীতি আমরা মোকাবেলা করতে পেরেছি। ব্যবসা-বাণিজ্য কখনও একেবারে বন্ধ হয়নি এবং পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল থাকায় বাংলাদেশে বড় কোন ধাক্কা লাগেনি।
তিনি আরও বলেন, কোভিডের মধ্যে আমাদের কৃষি মজুরি কমেনি,এর মানে হলো কৃষকদের হাতে টাকা আছে। সবকিছু মেলালে দেখা যায়-কোভিড বাংলাদেশে কর্মংস্থানে ধাক্কা দিলেও বড় আকারে কর্মহীন হওয়ার ঘটনা ঘটেনি।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর মনে করেন, আমাদের অর্থনীতি যেভাবে চলছে সেটা পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ভাল চলছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এপ্রিলে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছিলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের পাশে আছে, এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা সঞ্চারিত হয়। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে দেখতে পাচ্ছি।
জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদের মতে কোভিডকালীন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল থাকার পেছনে কয়েকটি ফ্যাক্টর দারুনভাবে কাজ করেছে-এগুলো হলো সরকারের সময়োপযোগি ও সাহসী নীতিমালা,পুরো সময়জুড়ে কৃষি খাত সচল থাকা, গ্রামীণ অকৃষিখাতও ভাল করেছে এবং ডিজিটাল রূপান্তরের কার্যকারিতার সুফল। এর পাশাপাশি করোনার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত তারল্য আছে বিশেষ করে রেমিটেন্সের অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে তারল্য সরবরাহ করেছে। এছাড়া রপ্তানি স্বাভাবিক সময়ের অবস্থায় ফিরে এসেছে। পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে, এতে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরও জোরালো হবে।
বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে করোনার মধ্যে আমরা লড়াই করে টিকে আছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সতকর্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় কোভিডকালীন সময়ে সামগ্রিক অর্থনীতির পাশাপাশি বাজারদর বিশেষ করে চাহিদা-যোগান অর্থাৎ সরবরাহ কাঠামো স্বাভাবিক রাখতে পেরেছি, যেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, আমরা ভাল আছি বলেই কোভিডের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের সাহস দেখাচ্ছি এবং ইতোমধ্যে তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, কোভিডের শুরুতে আমরা যে ধাক্কাটা খেয়েছিলাম, সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। যেহেতু চীনের ওপর শিল্পের কাঁচামালের জন্য আমরা অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই করোনার শুরুতে সরবরাহ কাঠামোয় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তবে এই সংকটের সুযোগে তৈরি পোশাক খাতে কাঁচামাল উৎপাদনের বেশ সক্ষমতা দেশেই তৈরি হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের পুরো সময়জুড়েই গ্রামীণ অর্থনীতি চালু ছিল, এতে আমরা দেখতে পেয়েছি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির শক্তিমত্তা। এর পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রবাহ আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। তিনি মনে করেন, তৈরি পোশাক কারখানা খুলে দেয়াসহ সরকারের নীতিমালাগুলো কোভিড মোকাবেলায় দারুন কাজ করেছে।
ব্যবসায়ী এই নেতা কোভিডের নেতিবাচক প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে এসএমই প্রণোদনা প্যাকেজ সফলভাবে বাস্তবায়ন, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান অবনমন, নবগঠিত মুক্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট আরসিএপিতে যোগদানের প্রয়াস গ্রহণ ও কোভিডের প্রকৃত আর্থিক ক্ষতির সঠিক হিসাব নিরুপন সাপেক্ষে নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ এন্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভলপমেন্ট (র্যাপিড) এর নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফ বলেন, কোভিডের মধ্যে ঝুঁকি নিয়েই খুলতে হয়েছে শিল্প-কলকারখানা। এর পাশাপাশি প্রণোদনা ও রাজস্ব সহায়তা স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করেছে। তিনি বলেন, বড় বিষয় হলো কোভিড আমাদের অর্থনীতিতে সে অর্থে বড় কোন সংকট তৈরি করতে পারিনি। তিনি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় জনগোষ্ঠিকে নতুন করে আবার প্রণোদনার আওতায় আনার পরামর্শ দেন।
Go to Source
January 1, 2021
5:00 AM